• ঢাকা
  • |
  • শুক্রবার, ২রা মে ২০২৫
  • - ৩৩° সে:
Language

নারী কথন

নারী হত্যা–আত্মহত্যা: বছরে ৫০০, কোনো কোনো বছর ৭০০

বুনন নিউজ

বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে আগস্ট ২০২২

প্রতীকী ছবি

বছরে ৫০০, কোনো কোনো বছর ৭০০।

তাঁদের কেউ শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন, কেউ নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। কোনো কোনো নারী আবার সরাসরি হত্যাকাণ্ডের শিকার। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) একটি পরিসংখ্যানে পাওয়া গেছে এই হিসাব। সংস্থাটি বলছে, ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে মোট ৩ হাজার ৩৭৬ জন নারী হত্যার শিকার হয়েছেন বা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। বছর অনুযায়ী আলাদা করে বললে, ২০১৭ সালে ৫৯৭ জন, ২০১৮ সালে ৫২৮, ২০১৯ সালে ৫৮৭, ২০২০ সালে ৬৬১, ২০২১ সালে ৬৮৪ ও চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ৩১৯ জন নারীর জীবনে এই চরম ঘটনা ঘটেছে; অর্থাৎ মাসে গড়ে ৫০ জনের বেশি নারী হারিয়ে যাচ্ছেন। যেখানে আত্মহত্যার চেয়ে হত্যার সংখ্যাই বেশি।

প্রথম আলোসহ ৯টি জাতীয় দৈনিক, কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও নিজেদের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছে আসক। যৌন হয়রানি ও সহিংসতা, ধর্ষণ, যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতন—মোটাদাগে এ ধরনের নির্যাতনের পর কত নারীকে হত্যা করা হয়েছে এবং কত নারী আত্মহত্যা করেছেন, তার পরিসংখ্যান রাখছে আসক। পরিসংখ্যান বলছে, স্বামী ও স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতে হত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে। তবে নিজ পরিবারের সদস্যদের হাতে খুনের ঘটনাও কম নয়।

শুধুই পরিসংখ্যান নয়

২৯ জুন ২০২২। আগুনে দগ্ধ হয়ে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন অদিতি সরকার (৩৮)। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের তিনি রেজিস্ট্রার। ৫০ শতাংশ দগ্ধ অদিতিকে ফেরানো যায়নি। অদিতির দুই সন্তানের মধ্যে একজনের বয়স এখন পাঁচ বছরের সামান্য বেশি আর ছেলের সাত মাস। পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) শাহ ইফতেখার আহমেদ অদিতির দেওয়া বয়ান উল্লেখ করে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, স্বামীর সঙ্গে অভিমান করে নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন অদিতি।

২১ আগস্ট অদিতি সরকারের মা সবিতা রানী রায়ের সঙ্গে কথা হলো। তিনি রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক। রাজশাহীতেই থাকেন। মুঠোফোনে বললেন, ‘আমার এক ছেলে, এক মেয়ে...এখন মেয়েটা নেই।’ সন্তান হারানোর কষ্ট চেপে আবার বললেন, উচ্চশিক্ষিত ও কর্মজীবী একজন মেয়ে কোনো কারণ ছাড়া তো আর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেবেন না। হয়তো দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। তিলে তিলে তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে।

অদিতি সরকার তাঁর মায়ের কাছে কোনো পরিসংখ্যান নন, আদরের মেয়ে। তাই বছরে ৫০০, ৬০০ বা ৭০০ নারীর হিসাব মোটাদাগে অনেকের কাছে শুধুই পরিসংখ্যান হতে পারে, কিন্তু ভুক্তভোগী পরিবারের কাছে তা নয়।

আয়ুর সঙ্গে হত্যাও বেড়েছে

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে, দেশে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। ২০২০ সালে করা বিবিএসের অন্য আরেকটি জরিপ বলছে, পুরুষের তুলনায় নারীদের গড় আয়ু বেড়েছে।

নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, নারীর সংখ্যা ও গড় আয়ু যেমন বেড়েছে, তেমনি হত্যাও বেড়েছে। বেড়েছে নারীর আত্মহত্যার হারও। সরকারকে দ্রুত এ বিষয়ের ওপর নজর দিতে হবে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু প্রথম আলোকে বলেন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের একপর্যায়ে নারীকে মেরে ফেলা হচ্ছে, নয়তো নারী মরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। শুধু স্বামী, স্বামীর পরিবারের সদস্য নন, সম্মান রক্ষার কথা বলে নিজ পরিবারের সদস্যরাও নারীকে মেরে ফেলছেন। যেকোনো পারিবারিক দ্বন্দ্বেও মূল টার্গেট হন পরিবারের নারী সদস্যটি। এটি সুস্থ-স্বাভাবিক সমাজের চিত্র হতে পারে না।

বাবা মেয়েকে মারছেন, ছেলে মাকে, স্বামী স্ত্রীকে

২ আগস্ট প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, উদ্ধার হওয়া অর্ধগলিত একটি লাশকে নিজের মেয়ের বলে শনাক্ত করেছিলেন বাবা রফিকুল ইসলাম। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলেন। মামলার সাত দিনের মাথায় পুলিশ জানিয়েছে, লিপি বেগম (২২) নামের ওই তরুণীকে হত্যা করেছিলেন তাঁর বাবা রফিকুল ইসলাম নিজেই। মেয়ের ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’-এ অতিষ্ঠ হয়ে তাঁকে খুন করে লাশ পুঁতে রাখেন। ১৬৪ ধারায় অপরাধ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন লিপির বাবা।

আসকের প্রতিবেদন বলছে, নারীরা পারিবারিক সহিংসতা ও যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় স্বামী ও স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতে বেশি খুন হয়েছেন।

১২ আগস্ট প্রথম আলোর আরেকটি প্রতিবেদন বলছে, পরিবারকে না জানিয়ে দুই বছর আগে চিকিৎসক জান্নাতুল নাঈম সিদ্দিককে বিয়ে করেছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী রেজাউল করিম। একাধিক নারীর সঙ্গে রেজাউলের সম্পর্ক রাখা নিয়ে তাঁদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। এর জেরেই পরিকল্পিতভাবে জান্নাতুলকে গলা কেটে খুন করেন রেজাউল। ঘটা করে জন্মদিন পালনের কথা বলে রাজধানীর একটি আবাসিক হোটেলে এনে তাঁকে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রাম থেকে রেজাউলকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব।

১৪ আগস্ট প্রথম আলো একটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘রাতে জামাতা বললেন, “আপনার মেয়েকে মারতে মারতে মেরে ফেলব”, সকালে মিলল লাশ’। বাবাকে ফোন করে তাঁকে বাঁচাতে বলেছিলেন মনিরা খাতুন। মনিরার কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে স্বামী সজীব মোল্লা শ্বশুরকে জানিয়েছিলেন, তাঁর ২০ হাজার টাকা লাগবে। কুষ্টিয়ার মিরপুরের মনিরার তিন বছর ও আট মাস বয়সী দুটি মেয়ে আছে।

পারিবারিক দ্বন্দ্বে ছেলে মাকে মেরে ফেলছেন, এমন ঘটনাও ঘটছে। প্রথম আলোতে৬ আগস্টের এক প্রতিবেদন বলছে, চট্টগ্রামে ৫০ বছর বয়সী জেসমিন আক্তারকে গুলি করে হত্যা করেন তাঁর বড় ছেলে মাইনুউদ্দিন। জমিজমা-সংক্রান্ত কারণে জেসমিন আক্তারকে নিজের শোবার ঘরে ছেলের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মরতে হয়।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি

আসকের পরিচালক নীনা গোস্বামী প্রথম আলোকে বলেন, আসক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে পরিসংখ্যান রাখছে। এর বাইরেও তো আরও ঘটনা ঘটছে। এই যে হত্যা বা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে, এর পেছনের মূল কারণ বিচারহীনতার সংস্কৃতি। নারীর প্রতি সহিংসতার মামলাগুলো বিশেষ মামলা হিসেবে নজর পাচ্ছে না। নিম্ন আদালত পার হয়ে উচ্চ আদালতে গিয়ে মামলাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। দৃষ্টান্তমূলক সাজা হয়েছে, এমন নজির না থাকায় অপরাধীরাও অপরাধ করতে উৎসাহিত হচ্ছেন।

অদিতি সরকারের মা সবিতা রানী রায়ের সঙ্গে আলাপে ফিরে আসি। মেয়েকে হত্যার মামলা নিয়ে সেদিন তাঁর সঙ্গে আরও কথা হয়েছিল। তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর শক্ত মনের হাসিখুশি মেয়েটি আত্মহত্যা করতে পারেন, এটা তিনি বিশ্বাস করেন না। তবে ঘটনার পর দুই নাতির কথা চিন্তা করে মামলা করেননি। তাঁর কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে দেশের বিচারব্যবস্থা নিয়ে, মামলা করেই-বা কী হবে, ছয় বা সাত মাস জেলে থাকার পর অভিযুক্ত ব্যক্তি জেল থেকে তো ঠিকই বের হয়ে আসবেন।