মেহতাব খানম
পাঠকের কাছ থেকে মনোজগৎ, ব্যক্তিজীবন ও সন্তান পালনের মতো সমস্যা নিয়ে ‘পাঠকের প্রশ্ন’ বিভাগে নানা রকমের প্রশ্ন এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।
প্রশ্ন: আমি বাড়ির বড় মেয়ে, বয়স ৪৪ বছর। পড়াশোনা, চাকরি আর নিজেকে গোছাতেই আমার একটা লম্বা সময় কেটে গেছে। তাই বিয়ে করার সময় পাইনি। বাবা মারা যাওয়ার কারণে পরিবার চালানো, ছোট ভাইবোনদের পড়াশোনা, তাদের প্রতিষ্ঠিত করা—সবই আমাকে করতে হয়েছে। এখন সবাই যার যার মতো প্রতিষ্ঠিত। সবার বিয়ে হয়ে গেছে। এক বোন বিদেশে চলে গেছে। আমি মায়ের সঙ্গে থাকি। এখন সবাই আমাকে বিয়ে করতে বলছে, কিন্তু আমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। আরও একটি বিষয় হলো, বিয়ে করলে এখন আমার যোগ্য পাত্র যা মেলে, তাঁরা হয় ডিভোর্সি নয়তো বিপত্নীক, সন্তান আছে—এমন লোকজন। তাই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে আছি। আবার একা বাকি জীবন কাটাতে পারব কি না, সেটাও ভাবতে হচ্ছে। মানসিক এক ধরনের অশান্তি কাজ করছে। আমি একটা ভালো চাকরি করি, তাই টাকাপয়সা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নই। পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করবেন আশা করি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, রংপুর
উত্তর: আপনার চিঠিটি পড়ে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা বোধ করেছি। বোঝা যাচ্ছে, কর্তব্যপরায়ণতা ও নিষ্ঠা দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে আপনি একটি পরিবারের অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন। বাবার অনুপস্থিতিতে পরিবারটি যে সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, আপনি তা নিজের পরিশ্রম ও উপার্জন দিয়ে সামাল দিয়েছিলেন। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো পরিবারের জন্য ব্যয় করতে দ্বিধা করেননি।
ভাবছিলাম, এত দিন পর কি আপনাকে সবাই বিয়ের কথা বলছে? আগে আপন লোকেরা বলেননি? যা–ই হোক, পরিবারের জন্য এ কাজ করার মধ্য দিয়ে আপনারও হয়তো একধরনের সন্তুষ্টি ও ভালো লাগা কাজ করেছে। এখন সঙ্গী হিসেবে আপনার মতো অবিবাহিত কাউকে পেলে নিশ্চয়ই খুব ভালো হতো, তবে আমরা কেন বিয়ে করি, সেই কারণগুলো ভালোভাবে ভেবে দেখতে পারেন।
বিয়ে যদিও একটি সামাজিক, আইনগত ও ধর্মীয় বন্ধন, যা আজীবন টিকে থাকবে বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে সবচেয়ে বড় কারণ আসলে মানুষ সাধারণত একা একা জীবন কাটাতে পছন্দ করে না। জন্মের সময় মায়ের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর মানবশিশু প্রথমেই বড় ধরনের একটি ধাক্কা খায়, ভেতরে-ভেতরে প্রচণ্ড ভীতির সঞ্চার হয় তার মনে। সেই সময়ে কেউ যদি শিশুটিকে পরম আদরে ও অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে কোলে তুলে নিয়ে নিজের শরীরের স্পর্শ দেয়, তাহলে সে খুব স্বস্তি ও নিরাপদ বোধ করে।
বড় হওয়ার পথে আমরা পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে আরও কিছু বন্ধুবান্ধব খুঁজতে শুরু করি। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সময় আমরা মনে মনে বিশেষ কাউকে খুঁজতে থাকি, যে কিনা আমাদের অফুরন্ত ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব দিয়ে পাশে থাকবে। মানসিক চাহিদার সঙ্গে তখন শারীরিক চাহিদার বিষয়টিও অনেক গুরুত্ব বহন করে। আপনার জীবনে এমন কারও উপস্থিতি কতটা তীব্রভাবে অনুভব করেন, সেটি খুব ভালোভাবে ভেবে দেখবেন, কেমন?
আর এমন কাউকে যদি খুঁজতে চান, তাহলে বিয়ের কথা মাথায় রেখেই সম্ভাব্য কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আগে বুঝতে চেষ্টা করুন, তাঁদের কারও সঙ্গে আপনার মূল্যবোধ ও রুচিবোধের সামঞ্জস্য রয়েছে কি না। বিশেষ করে মেয়েদের প্রতি সেই মানুষটার যথেষ্ট শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে কি না, সেটি বুঝে নেওয়া খুবই জরুরি। কাজেই ডিভোর্সি বা বিপত্নীক কি না, সেটির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, দুটি মানুষের মধ্যে মনের বোঝাপড়া। এ ছাড়া বিবাহবন্ধনের প্রতি দায়বদ্ধতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বিশ্বাস—এই বিষয়গুলোর উপস্থিতিও খুব প্রয়োজন। এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে দুজনকেই অবশ্য সমানভাবে অবদান রেখে সম্পর্কটিকে খুব যত্ন করে এগিয়ে নিতে হবে।
আশা করি, একজন জীবনসঙ্গীর চাহিদা পূরণের লক্ষ্য মাথায় নিয়ে বয়স ও অভিজ্ঞতার কাছাকাছি কিছু মানুষের সঙ্গে আগে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করবেন। এরপর পরিবারের মানুষদের সঙ্গে আলোচনা করে শেষ সিদ্ধান্ত নিন। তবে মনে রাখবেন, বিয়ে করা অনেক সময় সহজ মনে হলেও সেটিকে সুন্দরভাবে টিকিয়ে রাখার জন্য অনেক প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
(এই bunonnews.tv ওয়েভ-সাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বে-আইনি)
© 2025, বুনন নিউজ টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT