• ঢাকা
  • |
  • বুধবার, ৭ই মে ২০২৫
  • - ৩৩° সে:
Language

লাইফস্টাইল

শাহনাজ সুলতানার খাঁচায় প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০টি শাড়ি তৈরি হয়

বুনন নিউজ

বৃহঃস্পতিবার, ১লা সেপ্টেম্বর ২০২২

খাঁচার কারখানায় পূজার পোশাকে নকশার কাজ করছেন কর্মীরা

শাড়ির পাড়জুড়ে হারমোনিয়ামের রিড, আঁচলে শহরের দালানকোঠা, রাতের ল্যাম্পপোস্ট, সবুজ প্রকৃতি, সাগরের ঢেউ, কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরি—আপন খেয়ালে এসব এঁকেছিলেন শাহনাজ সুলতানা। কে জানত, একদিন তাঁর এই সব আঁকিবুঁকি একটি প্রতিষ্ঠানের পণ্য হয়ে উঠবে।

শাহনাজ সুলতানা পড়তেন ইংরেজি সাহিত্যে। নেশা ছিল ছবি আঁকার, গান করার, লেখালেখির। শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ নয়, নেশাই তাঁকে নিয়ে যায় পেশায়। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম ‘খাঁচা’, যার লোগোতে লাগানো আছে দুটি পাখা। অর্থাৎ প্রথা ভেঙে মুক্ত আকাশে উড়ে যাওয়ার স্বপ্নের নাম খাঁচা। মাত্র ছয় বছরে খাঁচা অনেক দূরে উড়ে গেছে। এই উদ্যোক্তার কথা হচ্ছে, ‘বাজারে যা বেশি চলে, তার ব্যবসাই যদি করতাম, তাহলে তো চালের দোকানদারি করতাম। আমি এমন জিনিস তৈরি করব, তা কেনার জন্য প্রতিদিন নতুন ক্রেতা তৈরি হয়ে যাবে। এটাই উদ্যোক্তার কাজ।’ এখন খাঁচায় প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০টি শাড়ি তৈরি হয়। প্রতিদিন সব বিক্রি হয়ে যায়। তার বেশির ভাগ ক্রেতা চট্টগ্রাম ও সিলেটের। রাজশাহীতে মাত্র ১৩ শতাংশ ক্রেতা রয়েছে। সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের ১২৮টি তাঁতের সঙ্গে তাদের চুক্তি রয়েছে। সারা বছর তারা খাঁচার জন্য থান কাপড় বোনে। খাঁচায় এনে তাতে থিম ধরে নকশা করা হয়।

খাঁচার কারখানাটি রাজশাহী নগরের মুন্নাফের মোড় এলাকায়। ‘পাঠাও’–এর রাইডার পণ্য ক্রেতার বাড়িতে পৌঁছে দেন। দেখেশুনে ফরমাশ করা পণ্যটি মিলে গেলেই টাকা দিতে হয়। পছন্দের সঙ্গে না গেলে বা কোনো ত্রুটি থাকলে রাইডারের খরচ দিতে হয় না। এটা খাঁচার ক্রেতাদের মধ্যে দারুণ বিশ্বাস তৈরি করেছে। তাঁরা নিশ্চিন্তে ফরমাশ পাঠান।

খাঁচার মূল পণ্য হচ্ছে শাড়ি, কুর্তি আর ব্লাউজ। শাড়ি ৮৫০ থেকে ৫ হাজার ৫০০ টাকা, কুর্তি ৫৫০ থেকে ৮৫০ টাকা ও ব্লাউজ রয়েছে ৪৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকা দামের।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর গ্রামে শাহনাজ সুলতানার বাড়ি। বাবা বগুড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষক। মা মনিরা পারভীন গৃহিণী। তাঁরা দুই ভাইবোন। ভাইটি ছোট। এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। শাহনাজ সুলতানা রাজশাহীর বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন। তখন থেকেই ছবি আঁকা, গান করা ও লেখালেখির নেশা ছিল। আপন খেয়ালে কাপড়ে, শাড়িতে আঁকিবুঁকি করতেন। ২০১৬ সালের কথা। তিনি প্রথম বর্ষে পড়েন। এ সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেলায় তিন হাজার টাকা দিয়ে তাঁরা তিন বন্ধু একটা স্টল নিলেন। নিজের আঁকা কাপড় নিয়ে স্টলে বসেন। প্রথম দিনই সব বিক্রি হয়ে যায়। সারারাত জেগে আবার তৈরি করেন। পরের দিনও সব বিক্রি হয়ে যায়। তিন দিনের মেলায় তাঁর সব পণ্য বিক্রি হয়ে যায়। দারুণ উৎসাহিত বোধ করেন। ধীরে ধীরে তিনি একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করান। নাম দেন খাঁচা।

খাঁচার প্রতিষ্ঠাতা শাহনাজ সুলতানা
খাঁচার প্রতিষ্ঠাতা শাহনাজ সুলতানাছবি: সংগৃহীত

এখানে এখন প্রায় ৬০ জন কর্মচারী কাজ করছেন। শাহনাজ সুলতানা খাঁচার ফাউন্ডার ও ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি উৎপাদনের বিষয়টি দেখেন। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন নওসাদুল ইসলাম। তিনি খাঁচার বাণিজ্যিক এবং দাপ্তরিক পরিবেশ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ‘সাসপট’ নামে তাঁর একটি আইটি ফার্ম আছে। এখন সাসপট ও খাঁচা সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে।

খাঁচায় কাউকে কর্মচারী বা কর্মকর্তা বলে সম্বোধন করা হয় না। একজন অপরজনের টিমমেট বা সহযোদ্ধা হয়ে কাজ করেন। শাহনাজ সুলতানা বললেন, ‘একজন পিয়নকে যদি আমি পিয়ন হিসেবে গণ্য করি, তাহলে সারা জীবন পিয়নই থেকে যাবে। কোনো দিন বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারবে না। এ আচরণগুলোও সবাইকে শেখানো হয়।’

প্রতিষ্ঠানের প্রায় অর্ধেক কর্মচারী শিক্ষার্থী। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে খাঁচায় কাজ করেন। যেমন বগুড়ার মেয়ে আসিফা পারভীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগের শিক্ষার্থী। পড়ছেন দ্বিতীয় বর্ষে। বেলা দুইটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত খাঁচায় কাজ করেন। আসিফা বললেন, এই কাজ করে তিনি আনন্দ পান। সোমবার সকালে গিয়ে দেখা গেল একটি শাড়ির নকশা করছেন তিনি। সামনে দুর্গাপূজা। শাড়ির থিমটা সেই উৎসবকে ধরেই করছেন। নূর সাবা আলম রাজশাহী মহিলা কলেজের দর্শন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। তিনি পড়াশোনার ফাঁকে খাঁচায় প্রোডাকশন ডিজাইনার হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর বাড়ি রাজশাহী নগরের শালবাগান এলাকায়। নূর সাবা বললেন, খাঁচায় ক্লাসের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়। এ জন্য এখানে কাজ করতে ভালো লাগে।

খাঁচার ফেসবুক পেজ থেকে তাঁদের পণ্য ক্রেতাদের কাছে প্রচারের জন্য ১৫ জন কর্মী রয়েছেন। তাঁদেরও কর্মী বলা হয় না। তাঁদের পদবি হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া মডারেটর। তাঁরা ক্রেতাদের সঙ্গে নতুন পণ্যের পরিচয় করে দেন। খুদে বার্তা পাঠিয়ে তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দেন। কেউ যখন ফরমাশ করেন, তখন তাঁর সঙ্গে তাঁরা ফোনে কথা বলেন। রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী রাফিফা তাসনিম এখানে মডারেটর হিসেবে কাজ করেন। তিনিও খাঁচার কাজে স্বচ্ছন্দের কথা বললেন।

খাঁচায় ঢুকে দেখা গেল, এর প্রতিটি দেয়ালে শিল্পকর্ম ঝুলছে। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বোঝার উপায় নেই যে এটি একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সবকিছুর মধ্যেই নান্দনিকতার ছোঁয়া। শাহনাজ সুলতানার নিজের টেবিলটার ওপরও ছোট্ট একটি শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে।

খাঁচা থেকে নামার সময় লিমন নামের একটি ছেলে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন। কাজের পাশাপাশি খাঁচায় এসব শিষ্টাচারও শেখানো হয়।